Bangla romantic Story with Love

 


গভীর রাতে প্রায়ই একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙ্গে দিশার। মনে হয় কেউ যেন তার আশে পাশেই রয়েছে। কিন্তু কক্ষের বাতি জ্বলালেই দেখা যায় কক্ষে সে ছাড়া আর কেউ নেই। 😍


রাতের পৃথিবীটা বেশ শান্ত এবং নীরব। যার কারণে দূরের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। রাতে শুনতে পাওয়া এই নিঃশ্বাসের শব্দ দিশার কানে স্পষ্টভাবেই ভেসে আসে। মনে হয় মানুষটা তার একদম নিকটেই। 😍😘


যে রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সে রাতে চোখের পাতায় ঘুম আনা যেন ভীষণ কষ্টকর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে দিশা। ঠান্ডা বাতাস বইছে খোলা জানালা দিয়ে৷ শীতকাল চলে এসেছে একটু একটু করে। জানালা বন্ধ করার জন্য জানালার কাছে দাঁড়ায় দিশা। চোখ জোড়া বাহিরে পড়তেই কেঁপে ওঠে সে। একটা অস্পষ্ট মুখ কিন্তু খুব চেনা তার। তাড়াতাড়ি টর্চ খুঁজতে লাগলো। খুঁজে পেয়ে গেলে অন্ধকারের সেই মুখটার দিকে আলো স্থির করলো। কিন্তু কোথাও কোনো মুখ দেখা গেল না। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে সে।😘


আগামী মাসে দিশার বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায় তার মনে। জামিলকে বিয়ে করার জন্য বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকে। তবুও প্রশান্তি, জামিলকেই সে জীবনসঙ্গী হিশেবে পেতে যাচ্ছে।


দিন যত যাচ্ছে, বিয়ের দিন তত ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু রাত গভীর হলেই নিঃশ্বাসের শব্দটা ভাবিয়ে তুলছে দিশাকে। 😘মাঝে মাঝে সেই অস্পষ্ট মুখটা দেখে আঁতকে ওঠার কথাটা আর চেপে রাখতে পারলো না নিজের মাঝে।


'জামিল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।'


'বলো।'😊


'আমি প্রায় রাতেই একটা মহিলার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। প্রথম প্রথম গুরুত্ব না দিলেও একদিন অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট মুখ আমাকে ভাবিয়ে তুলছে ভীষণ।'


বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে জামিল, 'কাকে দেখতে পেয়েছো তুমি?'


ভীত স্বরে জবাব দেয় দিশা, 'রাবেয়াকে।'


ভয় পেয়ে ওঠে জামিল। থতমত স্বরে বলে, 'পাগল হয়েছো তুমি? রাবেয়া আসবে কি করে! এটা অসম্ভব।'


'আমিও তো তাই জানি। কিন্তু একদিন নয় আমি প্রায়ই রাবেয়াকে জানালার ওপাশে তাকালেই দেখতে পাই। মুখটা অস্পষ্ট হলেও আমি বেশ চিনতে পারি ওর মুখ। কি ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে😍।'


'তুমি হয়তো বিষয়টা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করো, তাই এমন হচ্ছে।' 


'আমারও যদি তোমার মত মনে হত। তবে শান্তি পেতাম।'


'শান্ত হও। আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।'


'তাই যেন হয় জামিল।'


বাড়ি জুড়ে বিয়ের আয়োজন চলছে। দিশার আত্মীয়রাও জমা হয়েছে বাড়িতে। ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে, এমনই পরিকল্পনা দুই পক্ষের।


গুটি কয়েক আত্মীয় স্বজনের মাঝে বিয়ে নিয়ে কানাঘুঁষা চলছে। পাঁচ ছয়জনের আসরে বেশ জমে উঠেছে সে আলাপ আলোচনা।

'ছেলের আগে একটা বিয়ে ছিল। তবুও কেন যে মেয়েটা এই ছেলের জন্য এত পাগল হলো!'


'তাতে কি! ছেলের ক্যারিয়ার কত ভালো। তাছাড়া বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান সে। বিয়ে একটা কেন পাঁচটা হলেও দিশার মত মেয়ে বিয়ে করার ক্ষমতা সে রাখে।'


অন্য একজন বলে উঠলেন, 'তা ঠিক বলেছেন ভাবি। তবে শুনেছি, আগের বউটা গরীব পরিবারের মেয়ে ছিল। কিন্তু মেয়েটা নাকি খুব ভালো ছিল।'


'হ্যাঁ, আমি শুনেছি মেয়েটা খুবই ভালো ছিল। দুর্ভাগ্য যে অকালে মারা গেল।'


'আত্মহত্যা করেছিল। শুনেছিলাম, মাঝ রাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল।'


বেশ অবাক হয়ে একজন বললো, 'এত সুখের সংসার রেখে আত্মহত্যা করলো! অভাব ছিল না কোনো কিছুর! কেন মারা যেতে হলো?'


ফিসফিস করে একজন বলে উঠলো, 'মাথায় নাকি একটু সমস্যা ছিল। কেউ নাকি বুঝতে পারেনি, এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।'


'কি আর করার! কপালে সুখ না সইলে কত কিছুই তো হয়।'


হঠাৎ দিশার মা চলে এলে আসরের কথা বার্তা থেমে যায়। যে যার মত উঠে চলে যেত লাগলো যার যার কাজে।


ক্লান্ত শহরটা বিশ্রামে তলিয়ে। আগামীকাল সকালে বিয়ে। বাড়িটা বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কক্ষের মধ্যে দিশার দম বন্ধ হয়ে এলে ছাদে এসে দাঁড়ায়। সুনসান শহর৷ বাড়ির সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম নেই দিশার চোখে। হঠাৎ অনুভব করে কেউ যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। 


আঁতকে ওঠে দিশা। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে কেউ নেই। কিন্তু সে নিশ্চিত কেউ একজন তার পাশেই ছিল। তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু মিললো না কারো খোঁজ। ভয়ে ভয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ মনে হলো, পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিছন ঘুরে তাকায় দিশা। ভয়ে কুঁকড়ে যায় সে। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়েই ঘটে অঘটন। 😘


বিয়ের তারিখ পিছিয়ে যায়। ভাঙ্গা পা নিয়ে দিশার এখন সময় কাটে হুইলচেয়ারে। তবুও তার পিছু ছাড়ে না সেই মুখটা। রাত হলেই যার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় দিশা। 


'জামিল আমার বিশ্বাস রাবেয়া বেঁচে আছে। ও মারা যায় নি।'


'এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় দিশা। রাবেয়া মারা গিয়েছে।'

😍

'তাহলে আমি কেন রাবেয়াকে দেখতে পাই?'


'তুমি নিশ্চয়ই বিষয়টা ভুলতে পারছো না কোনোভাবে। তাই এমন হচ্ছে। আমার মনে হয় তোমার কোনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।'


'আমি কোনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চাই না।' ক্ষিপ্ত স্বরে বলে দিশা।😡


জামিল আর দিশা একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো। দিশার প্রতি একসময় জামিলের দুর্বলতা জমলেও পাত্তা দেয় না দিশা। কিন্তু যেদিন দিশা জানতে পারে জামিল উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে সেদিন সে নিজ থেকেই জামিলকে পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে।  সম্পর্ক গড়ে তোলা দু'জন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী দিশা একসময় জামিলকে রেখে সম্পর্ক গড়ে তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর প্রেমিকের সঙ্গে। জামিলের মন ভাঙ্গলেও দুর্বলতা রয়ে যায় দিশার প্রতি। 🥰


দুর্বলতা কাটাতেই মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় জামিল। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে রাবেয়া জামিলকে তার সমস্ত ভালোবাসা দিয়েও দখল করতে পারে নি কখনো দিশার স্থান। রাবেয়ার মাঝে আধুনিকা দিশাকে খুঁজে না পেয়ে রাবেয়ার প্রতি জামিলের ভেতর দূরত্ব আরও বাড়ে৷ 


কয়েক বছর বাদেই পুরাতন সব অভিমান অভিযোগ ধুয়েমুছে নতুন করে দিশার আবির্ভাব ঘটে জামিলের জীবনে। দুর্বলতার মাঝে আরও চেপে বসে দিশা। বাধা হয়ে দাঁড়ায় জামিলের পরিবার। স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা, রাবেয়ার প্রতি অবিচার করলে ছেলের প্রতি অবিচার করতে বাধ্য হবে। 😊


জামিল থামলেও, দিশা থেমে থাকার মানুষ নয়। রাবেয়াকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করার নানা উপায় বের করতে থাকে সে। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রতি পরিকল্পনা। তারপর বেশ এঁটে সেটে একটা বুদ্ধি বের করে। সফলও হয় সে পরিকল্পনা। কিন্তু রাবেয়ার এই নিঃশ্বাস এখন তার সুখের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্রমশ। 


'আমি কেন রাবেয়ার নিঃশ্বাস শুনতে পাই বলতে পারো জামিল?' কান্না জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করে দিশা।


'তুমি রাবেয়ার বিষয়টা এখনও মাথার মধ্যে চেপে রেখেছো দিশা। কিভাবে ভুলবে বলো!'😘


'না, আমি তো চেপে রাখি নি। আমি তো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছি সবকিছু ভুলে যাওয়ার। কিন্তু পেরে উঠছি না কেন!'


'তুমি শান্ত হও। উত্তেজিত হবে না। আমার মনে হয় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা উচিৎ।'


'ডাক্তারের কাছে আসল সমস্যা গোপন করে ঠিক চিকিৎসা পাওয়ার প্রত্যাশা কি করে করবো বলো তো? বৃথাই তো যাবে সব।'


চুপ করে থাকে জামিল। হুইলচেয়ারেই জীবন আবদ্ধ হয়ে রইলো দিশার। দিনে দিনে বিরক্ত হয়ে উঠেছে নিজের জীবনের প্রতি দিশা। 


দেখতে দেখতে শীতকাল চলে এলো। খুব সকাল আর গভীর রাতে কুয়াশারা ঢেকে রাখে শহর। গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে দিশার। জানলার কাঁচে কুয়াশা জমেছে। একটা নিঃশ্বাস আর খুব নিকটে থাকা একটা আবছা মুখ, যন্ত্রণা বাড়িয়ে তোলে দিশার। ভাঙ্গা পা নিয়েই মুখের পেছনে ছুটতে গেলে আবিষ্কার করে দিশা, ভাঙ্গা পা'টা একদম স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। খুশি না হয়ে বেশ ভয় পেয়ে যায় সে। ডাক্তার বলেছিল, পা'টা ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরকম আশ্চর্যজনক ঘটনায় ভীত হয়ে পড়ে দিশা। 


বাড়িসুদ্ধ লোক এই অদ্ভুত ঘটনায় বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলেও তা ঢাকা পড়ে পা ভালো হওয়ার খুশির তলে। 


'জামিল, গতকাল রাতে ও এসেছিল।'


'রাবেয়া?'


'হ্যাঁ। এই পা ভালো হওয়ার ঘটনাটা স্বাভাবিক নয় জামিল। গতকাল ও আমার খুব কাছেই ছিল। আমি ওকে ধরার জন্য এতটাই আকুল হয়ে উঠি যে ভুলে গিয়েছিলাম ভাঙ্গা পা'র কথা। ওর পিছু নিলেই আবিষ্কার করি ঘটনা, ভাঙ্গা পা আর ভাঙ্গা নেই। আমার কিছুই ভালো লাগছে না জামিল। কেন যেন এই বিষয়টাতে আমি খুশি হতে পারছি না।'


'আহা দিশা। তুমি এভাবে ভাবছো কেন! বিষয়টা এমন নয়।'


'বারবার আমার মনে হচ্ছে, আমার পা আগের মত থাকলেই যেন ভালো হতো।'


'এসব চিন্তা বাদ দাও। এবার আমাদের চিন্তা করা উচিৎ।'


মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় দিশা। জামিল হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে দিশার মুখের দিকে।


বাড়িতে আবার বিয়ে নিয়ে শোরগোল ওঠে। দিনতারিখ ঠিক হয়। আগামী সপ্তাহে বিয়ে। এবার আর আগের মত আয়োজন নয়, স্বল্প পরিসরে বিয়ের আয়োজনের কথাই ভাবছেন দুই পরিবার। 


কয়েকদিন যাবৎ দিশার আর নিঃশ্বাসের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে না। রাবেয়ার আবছা মুখটাও দেখতে পায় না। বিষয়টাতে বেশ খুশি হয়ে ওঠে সে। আগামীকাল দিশার বিয়ে। সেই আনন্দে দু'চোখে ঘুম আসছে না তার। আজ কেন যেন তার গভীর রাতের আকাশ দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ইচ্ছের তোড়জোড় এতটাই বেশি ছিল যে ছটফট করতে করতে ছাদে চলে যায় দিশা। আকাশ দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে যায় সে। ছাদের কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ায়। 


হঠাৎ একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে রাবেয়া দাড়িয়ে আছে, যেন সে জীবন্ত। চিৎকার করার আগেই একটা ধাক্কা লাগে দিশার শরীরে, তারপর ক্রমশ নিচে থেকে নিচে পড়তে থাকে সে। 


মনে পড়ে যায় দেড় বছরের আগের ঘটনা, এরকমই এক গভীর রাতের কথা। গভীর রাতের আকাশ ভালোবাসা রাবেয়া জামিলের সঙ্গে আকাশ দেখতে ছুটে এসেছিল ছাদে। বুঝতে পারেনি তাকে অন্ধকারের এক আকাশ দেখানো হবে। 

ছাদে এসে দাঁড়াতেই কথার বাহানায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ছাদের কর্নারে। তারপর এক ধাক্কায় ক্রমশ নিচে তলিয়ে যেতে থাকে তার দেহ। চিৎকার করার সুযোগ থাকলেও চিৎকার করেনি রাবেয়া। কেবল একটা নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। সকালের আলোয় অন্ধকারের সব ঘটনা ঢাকা পড়ে। আত্মহত্যা বলেই এখন অব্দি সকলে জানে। ঘটনার পুরো পরিকল্পনা করেছিলো, দিশা। জামিলকে দিয়েই তার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেয়। 😍


সকাল হলে লোক জড় হয় দিশার বাড়ি। খুনের কোনোই চিহ্ন মেলে নি৷ তাই এটাও আত্মহত্যা বলেই ধরে নেয় সকলে। কিন্তু ভেতরে আঁতকে ওঠে জামিল৷ মনে পড়ে সেই গভীর রাতের কথা। ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে সে। 


তারপর থেকে জামিল প্রায় রাতেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। একটা আবছা মুখও দেখতে পায়। সে বেশ ভালো করেই জানে, মুখটা আর কারো নয় রাবেয়ার। 

G-2


মাথায় যেন রক্ত উঠে এসেছে আমার। একটা ব্যাস্ত নগরে আম্মুকে এভাবে এই পরিস্থিতিতে দেখবো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

সিগন্যালে অনেকগুলো গাড়ি থামতেই চোখ পড়লো একটা এফজেটএস বাইকের দিকে। আম্মু একটা অপরিচিত লোককে ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে আছে, কত নিশ্চিন্তে। যেন নব্য প্রেমে পড়া একটি প্রেমিকযুগল মুক্ত হাওয়ায় উড়ছে;

এরকম একটা অপ্রস্তুত মুহূর্তকে পৃথিবীর কোন সন্তান কোনদিন কীভাবে নিয়েছে এটা আমার জানা নেই। আমি থমকে আছি। এখন আমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে জানেন?

অর্পাকে একটা ধাক্কা দিয়ে একটু দূরে সরালাম। মেয়েটা হঠাৎ আমার এহেন আচরণ দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই মেয়েটারও একটা বদ অভ্যাস আছে, যখন-ই আমার সাথে হাঁটবে তখন আমার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে টেনে টেনে হাঁটবে। ওর হাইট আমার থেকে নয় ইঞ্চি কম, সো যখন আমার হাত জড়িয়ে হাঁটে তখন আমার মনে হয় কেউ যেন আমার হাতে ঝুলাঝুলি খেলছে। একসাইট অলমোস্ট বাঁকা করে দিয়েছে এই মেয়ে। কোনদিন কিছু বলিনি আমি। এজন্য মোস্ট অব দ্য টাইম আমি ওকে নিয়ে রিকশা করেই ঘুরি। আজকেও ঝুলেই ছিল, ব্যাপারটা খুব অসহ্য প্যারা দিচ্ছিল এই মুহূর্তে। অর্পা বুঝে নাই আমি আসলে কেন এমনটা করেছি।

ভার্সিটির সেমিস্টার ফাইনাল দিয়ে খুলনা থেকে বাসায় আসছি গতকাল। সো ভাবলাম একটু দেখা করি অর্পার সাথে, একদম ফ্রেশ এয়ারে সকাল সকাল। অর্পা আসবে মোহাম্মদপুর থেকে, আর আমি নিকুঞ্জ। ঠিক করলাম দেখা করবো সংসদ ভবনের সামনে।

আমি এসে বসে আছি সকাল সাতটা থেকে। ভোরে বের হতে বলেছিলাম ওকে, ও মাত্র দুই ঘন্টা উনিশ মিনিট লেট করে এখন এসেছে। হেঁটে আসলেও মিনিট পনেরো সময় লাগার কথা। তবে এই সময়টা কাটানোর মতো একটা অবজেক্ট আমার কাছে ছিল;

অর্পার জন্য যখন এখানে এসে বসে ছিলাম তখন আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, যার সাক্ষী একমাত্র আমি ছিলাম। আশেপাশে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলনা। ঘটনাটা ছিল এরকম; একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা তার হাজবেন্ড সহ এখানে মেবি জগিং করতে আসছেন। এমন সময় মহিলার পরিচিত আরো কয়েকজন মহিলাকে পেয়ে কুশল বিনিময় করছিলেন দাঁড়িয়ে হাসিমুখে।

পরে দেখলাম ফুচকাওয়ালাদের পাতানো চেয়ারে সবাই গোল হয়ে বসতে লাগলেন, বোধহয় আড্ডা দিবেন জম্পেশ।

ঠিক এমন সময় ধপাস করে একটা শব্দ হল। সাথেসাথ হুহু করে একটা হাসির রোল। তাকিয়ে দেখলাম ওই মহিলাটা যিনি তার হাসবেন্ডকে নিয়ে এসিছিলেন উনি চেয়ারে বসতে গিয়ে নিচে পড়ে গেলেন। এত জোরেই পড়লেন যে চেহারাটা কান্না কান্না হয়ে গিয়েছে, খুব কষ্টে কান্না চেপে বসে আছেন মাটিতেই।

স্বামী বেচারা এক হাত মুখে দিয়ে হাসছেন আর আরেক হাত দিয়ে উনার স্ত্রীকে টেনে উঠাচ্ছিলেন। কোনরকম মহিলা উঠে দাঁড়িয়েই উনার স্বামীকে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে একরকম খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা খালি সিএনজি থামিয়ে উঠে চলে গেলেন। থাপ্পড়টার শব্দ উনি পড়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি ছিল। এখন সবাই নীরব। যাইহোক ঘটনা হল স্বামীই এখানে দোষী। উনি নিজেই মজা করতে গিয়ে কিংবা মজা দেখাতে গিয়ে দুষ্টুমি করে চেয়ার সরিয়ে ফেলছিলেন। মহিলার শিওর কোমরের হাড় ভেঙেছে। লজ্জাও পেয়েছেন খুব। পড়েই আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। সো থাপ্পড় যিনি খেয়েছেন উনি উচিৎ শিক্ষাটাই পেয়েছেন। আরো কয়েকটা দিয়ে আক্কেল ঠিক করে দেয়া উচিৎ ছিল বেক্কল লোকের।

এই শহর ক্ষণে ক্ষণে গল্প জন্ম দেয়। আমার গল্পে ফিরে আসা যাক;

এখনও সিগন্যাল ছাড়ে নাই। আমার আম্মু খুব করে উনার চেহারা লুকানোর নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো বুঝতে পারেননি আমি উনাকে দেখেছি কিনা। উনি শাড়ির আঁচল টেনে মুখ ঢেকে রেখে মুখটা বাইকের লোকটার ঘাড়ের ওপাশে নিয়ে রেখেছেন। জঘন্য দৃশ্য।

আব্বু প্রায়শই আম্মুকে এসব বিষয়ে খুব সন্দেহ করতো। আমি সেসব কেন যেন বিলিভ করতে পারতাম না। আম্মুকে যে খুব ভালবাসতাম। যদিও আমাকে তারা ছোটবেলা থেকেই খুব কাছে রাখেনি বাট বাসায় আসলেই এসব ঝামেলা দেখতাম। ডিভোর্স হয়ে যাবে যাবে অবস্থা অনেকদিন থেকেই।

আচ্ছা আমি আমার মাকে চিনবো না? ওনি আমাকে লুকাচ্ছেন? উনার সন্তানকে? আচ্ছা কীসের অভাব অনুভব করেন তারা? আমার বাবা মায়ের সম্পর্ক আমি আজ অবধি ভালো দেখিনাই কোনদিন। সারাক্ষণ একজন আরেকজনকে সন্দেহ করা। অথচ তারা নাকি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন! এটা কেমন ভালোবাসা ছিল তাদের? টাকা পয়সা কোন কিছুর অভাব ছিলনা। আমার আম্মু একজন শিক্ষিকা, আব্বু একটা কোম্পানির এমডি। এলিট লাইফ লিড করাটা জন্মের পর থেকেই আমি দেখছিলাম। বাট কোথায় যেন একটা সোশাল গ্যাপ রয়েই গিয়েছিল। আমি অনেকটা পাখির খাঁচায় বেড়ে উঠেছিলাম। অথচ আমিই কিনা একমাত্র সন্তান!

এতোটাই আধুনিক জীবন নিয়ে তারা ব্যস্ত ছিলেন যে আমি একটা উটকো ঝামেলা যেন হয়ে গিয়েছিলাম। যাক আমি বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করলাম। উনাকে আর অশান্তিতে রাখবো না।

খুব অসুস্থ লাগছে আমার এই মুহূর্তে। অর্পা কখন যেন রাগ করে চলেই গেল। মেয়েটার সাথে অন্যায় করলাম।

আব্বুর বিষয়টা আগে থেকেই জানা ছিল। উনি প্রায়ই নাইট ক্লাবে সময় কাটাতেন। বাসায় আসাটাও রেগুলার ছিলনা। এটা নিয়েই ঝগড়াটা বেশি বাধতো। একদিন তো মাথা কাটার মতো অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি। আমি কখনো নাইট ক্লাবে যাইনি কারণ আমি জানতাম ছোটবেলা থেকেই নাইট ক্লাবে বাবা যান, যার কারণে আম্মু প্রায়ই ঝগড়া করতেন। এটাকে নিকৃষ্ট কিছু ভেবেই বড় হয়েছিলাম। একটা ফ্রেন্ডের রিলেটিভের জন্মদিনে ওর সাথে বাধ্য হয়ে একদিন একটা ক্লাবে যাই। ওখানে গিয়ে হঠাৎ যখন আব্বুকে দেখলাম আমার বয়সী মেয়েদের নিয়ে নাচানাচি করছেন তখন আমার ইচ্ছে করছিল মরে যাই। রাগে ক্ষোভে দৌড়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

তখন শেষ ভরসার যায়গাটায় আমার আম্মু ছিল। আর আজ? সেও নেই। সেও তার মতোই জীবনটাকে উপভোগ করছে। বাহ্।

আব্বুর সাথে আমার কোনদিন ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। আম্মুর সাথেও যে খুব একটা ছিল তাও না। ছোটবেলায় ছিল কিনা তাও জানিনা। আম্মু তো কলেজ কোচিং পরীক্ষা ইত্যাদি নিয়েই থাকতো, আমি মানুষ হয়েছি বলতে গেলে কাজের বুয়ার কাছে। উনার নাম সোমা। সোমা আন্টিকে-ই আমি মা ডাকা শুরু করেছিলাম একটা সময়। উনি কোথায় আছেন এখন জানিনা।

আমি বুঝাতে পারছিনা কতটা সামাজিক প্রতিকূলতায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে হতো আম্মুর কোলে একটু শুই। আম্মুকে জড়িয়ে ধরি একটু। আব্বুর সাথে একটুখানি আড্ডা দেই বসে। জীবনে চলার জন্য মূল্যবান কিছু মোটিভ পাই কিংবা শাসন বারণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বু হোক বন্ধুর মতো। একটা সামাজিক প্লাটফর্মে আর যা যা থাকে কিছুই আমি দেখিনি শিখিনি। এতটুকু চাওয়া আর আক্ষেপ আমার পূর্ণ হয়নি জানেন। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই হোস্টেলে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি ওদের সন্তান-ই না। টাকা পয়সাটাই আজ মূখ্য হলে আমার এতো আক্ষেপ থাকতো না। এতো কিছুর পরেও আমি বেঁকে যাইনি। সুবোধ বালকের মতোই বেড়ে উঠেছিলাম।

অর্পার বন্ধু হয়ে ওর বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম গ্রামে। ওর মা আমাকে ভাত মাখিয়ে তুলে খাইয়েছিলেন, সাথে অর্পাকেও। তখনকার মুহূর্তটা খুব অপরিচিত লাগছিল আমার। এভাবে কখনো আমি আমার আম্মুর কাছাকাছি হইনি। অর্পার বাবা আমাকে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলেন, অনেক মূল্যবান গাইড দিয়েছিলেন। একটা সন্তান নিয়ে তার স্বপ্ন আমাকে বলেছিলেন। আমার স্বপ্ন নিয়েও জানতে চেয়েছিলেন, আমি কিছুই বলতে পারিনি।

ঐ পরিবারে অর্পার চাচা চাচী কাজিন ফুফু ইত্যাদি ইত্যাদি মানুষগুলোর বন্ডিং দেখে, আনন্দ দেখে আমার জাস্ট দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এসব আমি কিছুই দেখিনি পাইনি কখনো। আমি কিসের জীবন অতিবাহিত করেছি কিছুই জানিনা। সঙ্গী বলতে অর্পা মেয়েটা আমাকে কলেজ লাইফ থেকে না ধরলে এই জীবনটা মরা নদীর মতো হয়ে যেত। হয়তোবা বেঁকে যেতাম আমি। এই মেয়েটা আমাকে জিইয়ে রেখেছিল।

একটা সিগারেট ধরালাম। অর্পার প্রমিস ভেঙেই। এই একটা অভ্যাসই ছিল আমার বাজে তাও অর্পার হুমকিতে এটাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজকে আবার ধরেছি। ফোন বের করলাম অর্পাকে একটা কল দিবো বাট ফোনটা কখন যেন অফ হয়ে গেল। ইচ্ছা করছে না আর বাসায় যেতে। আম্মুর চেহারাটাও আর দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।

শেষমেশ রাত দশটায় বাসায় ফিরলাম। আম্মুকে দেখলাম খাবার টেবিলে বসে আছে। আমাকে দেখেই বলছে, তোমার ফোন অফ ক্যান? টইটই করে কোথায় ঘুরে বেড়াও সারাদিন? বাপের দেখানো রাস্তায় চলছো নাকি হ্যাহ?

মনে মনে ভাবলাম, এই মহিলা কতটা নির্লজ্জের মতো এসব বলছে সে নিজেও বুঝতে পারছেনা হয়তো। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে চেঁচামেচি শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। আবারও আম্মু আর আব্বুর ঝগড়া লাগছে। আজকে আব্বু অতিরিক্ত মাতাল হয়ে ঢুকছে মেবি। উনারা সম্ভবত ব্যাক্তিগত ব্যস্ততার কারণে ডিভোর্স নিতে পারছিলেন না। আম্মুকে শুনলাম কোন এক লয়ারকে বলছেন কালকে পেপার পাঠানোর জন্য। আব্বুকেও শুনলাম এটাতে খুব একমত। খুব সম্ভবত আনুষ্ঠানিক ভাবে আগামীকাল আমার বাবা মায়ের ডিভোর্সটা হয়েই যাচ্ছে।

আমার ব্যাপারটা নিয়ে এই মুহূর্তে কথাবার্তা হচ্ছে। আমি কার সাথে থাকছি এটা নিয়ে। আম্মু সরাসরি বলে ফেললো তোমার ছেলের দায়িত্ব তুমি নাও। আব্বুর বিকট একটা তাচ্ছিল্যের হাসির শব্দ শুনে আমি দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম। আব্বু বললো; কী বললা শায়লা, আবার বলতো? আমার সন্তান? আইভিএফ এর মাধ্যমে ডোনেটেড স্পার্মে বিদেশে গিয়ে জন্ম নেয়া একটা ছেলেকে আমায় ঠেলে দিচ্ছো? আম্মুকে দেখলাম এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো; আস্তে কথা বলো। লজ্জা করছেনা এসব বলতে? তোমার মতো কাপুরুষের জন্যই আমি দশ মাস দশ দিন একটা অত্যাচার সহ্য করেছি বুঝলা? আমার লাইফটা অনেক বেটার হতো আজকে। আব্বু বললো; এ তো তোমাকে দমানোর জন্য বাধ্য হয়েছিলাম। সন্তান আর উটকো ঝামেলার কোন দরকার-ই ছিলনা আমার। আমি কিন্তু অক্ষম ছিলাম না। জাস্ট বেবি হবেনা এরকম একটা ইস্যু ছিল। তারউপর তোমার মতো একটা চরিত্রহীনকে থামানোর জন্যই এতকিছু। আমার উপর কিছু চাপিয়ো না। আম্মু থাপ্পড় দিলো আব্বুকে।

আর নিতে পারছিনা, আর কিছু শুনতেও ইচ্ছে করেনি।

একটুও অবাক হইনি জানেন? বরং এই স্বাভাবিক সত্যটাই গেস করতাম আমি। আম্মু তো আমার আম্মু-ই ছিল তাইনা? পেটে ধারণ করাটা যে বিশেষ কিছু না এটা কতোটা সহজেই বুঝালো। মাথাটা তীব্র ব্যথায় যেন ফেটে যাচ্ছে। রুমে এসে হ্যাডফোন কানে গুঁজে ফুল ভলিউম দিয়ে শুয়ে আছি। ভাবছি আত্মহত্যা করে ফেলি। এটা কী একটা জীবন হলো আমার? একটা সুইসাইড নোট লিখতে বসলাম। লিখেও ফেললাম এক লাইনের কবির ওই বাক্যটা; জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

খুব ভোরে চুপিচুপি এগারো তলার ছাদে চলে আসলাম। রেলিংএ উঠে দাঁড়িয়েছি। খুব জোরে ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে। আফসোস হচ্ছে এই পৃথিবীতে একটা তেলাপোকাময় জীবন পেয়ে। আব্বুকে বাদ-ই দিলাম। একজন মা হয়ে দশ মাস দশ দিন গর্ভে নিয়েও কীভাবে আম্মু আফসোস করছে আমাকে জন্ম দিয়ে? ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর খুব।

আত্মহত্যায় আমার কী সমাধান হবে ভাবতে পারছি না। খামোখাই সস্তা ভাইরাল আর তাচ্ছিল্য পাবো। নেমে গেলাম। সুইসাইড নোটটাকে ফেলে দিলাম নিচে। ও-ই সুইসাইড করুক। আত্মহত্যার পর আত্মার ডিপ্রেশন কমানোর আর কোন সুযোগ থাকবেনা। বরং কিছুদিন ছুটে বেঁচে থাকি। এটাই গল্প হয়ে বাঁচিয়ে রাখুক আমায়। মানুষ কতোটা স্বাভাবিকের বাইরেও থাকতে পারে এর একটা উদাহরণ হয়ে হলেও থাকি বেঁচে।

পকেটে হাত দিয়ে দেখি ফোন আসছে। অর্পার ফোন।

- হ্যালো অর্পা।

- আসো দেখা করবো আজকেও। আজ লেট করবোনা প্রমিস।

- কালকের জন্য খুব স্যরি।

- ব্যাপারনা, আমিও আন্টিকে দেখেছিলাম বাইকে।

- আম্মুকে চিনলা কীভাবে?

- ভালো করেই চিনি রবিন, ছবি দেখেছি তোমার ফোনের ওয়ালে। ওই শাড়িটাই ছিল পরনে।

- ওহ্ এটা খেয়াল করিনি। জানো আব্বু আম্মুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো আমিও নাকি ওদের সন্তান ছিলাম না। আইভিএফ, ডোনেটেড স্পার্ম বুঝো? টেস্টটিউব বেবি চিনো?

- এতকিছু বুঝতে চাইনা, চিনতেও চাইনা।

- আচ্ছা আমি কী আত্মহত্যা করবো অর্পা? আমার শেষ আশ্রয়স্থল তো এখন তুমি। আমি আর চাচ্ছিনা এটা দেখতে যে তুমিও চলে গিয়েছো আমায় ছেড়ে। আমায় কী আর ভালোবাসবা কখনো?

- আমি যাচ্ছিনা কোথাও, যাবার জন্য ভালোও বাসিনি। তোমাকে আগলে রাখতেই আমি এসেছি, আছি এবং থাকব। চুপচাপ চলে এসো সব ছেড়ে সব ভুলে। আমরা এই শহর ছেড়ে কোন এক সভ্য অচিনপুর চলে যাবো। ওখানে ভালো থাকবো দেইখো।

ঘর থেকে ব্যাগটা কাধে নিয়ে একেবারে এই শহর ছাড়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। আর ফিরবো না এই যান্ত্রিক নগরে। ভালো থাকুক আমার আধুনিক আম্মু আব্বু কিংবা যারা আয়োজন করে আমাকে পৃথিবীতে এনেছিল।

ভুল আগমন

বাসর ঘরে ঢুকেই স্বামী খাটের একপাশে ধপাস করে বসে

পড়ে😘।স্বামীর আগমনের আভাস পেয়ে গুণবতী স্ত্রী খাট

থেকে নেমে প্রাণাধিককে সালাম করে।সালামের জবাব

দেওয়ার পর দুজনই কতক্ষণ নিরবতা পালন করে।এক সময় স্বামী

তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে ঘোমটাটা সরিয়ে নেয়।স্ত্রী খানিকটা

লজ্জাবোধ করে মাথা আরেকটু নিচু করে ফেলে😍।

স্ত্রীকে দেখে স্বামী প্রথমে নিজের মুখ খুলে।

স্বামী : দেখো আজ আমরা দুজন মিলে একটা নতুন জীবন শুরু

করতে যাচ্ছি।কিন্তু তার আগে তো আমাদের দুজন দুজনকে

জানতে হবে,বুঝতে হবে,তাই না?

স্ত্রী জ্বী বলে সাই দিলো।

স্বামী : দেখো তুমি আমার সব কাজের হিসেব নিতে পারো।

আমার এতে কোনো আপত্তি নেই🥰।আমার সাথে যা তা করতে

পারো আমি বারন করবোনা।কিন্তু আমার পছন্দ নিয়ে

কোনোদিন কিছু বলতে পারবেনা।বা আমার পছন্দ গুলো যদি

তোমার অপছন্দ ও হয় তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।তুমি কি

বলো?

স্ত্রী :আমি শুনছি আপনি আপনার পছন্দ-অপছন্দগুলো বলুন।

স্বামী :তাহলে শুনো,,প্রথমতো ধর্মের কোনো বিষয়

নিয়ে আমায় জোর করবেনা।এটা আমার পছন্দ না।

স্ত্রী :জ্বী ধর্মের কোনো বিষয় আপনার উপর জোর

করে চাপাবো না।তারপর????

স্বামী :দ্বিতীয়তো আমি নেশা করতে পছন্দ করি।যেমন-

সিগারেট,মদ,গাজা ইত্যাদি ইত্যাদি আমার নিত্যদিনের খাবার বলতে

পারো।এদের ছাড়া আমি একদিন ও চলতে পারিনা ।

স্ত্রী :কোনো ব্যপার না।আপনার সব ধরনের পছন্দ-

অপছন্দগুলো আজ থেকে আমার লিস্টে ও এড করে নিলাম।

স্বামী ভ্রু কুঁচকে,,,মানে???

স্ত্রী :মানে আপনি যা যা পছন্দ করেন আজ থেকে তা আমারও😘

পছন্দ,তারপর বলুন।

স্বামী :(কতক্ষণ চুপ থেকে)কি আর বলবো।আমার সব পছন্দ-

অপছন্দ যখন তুমি নিজের করে নিয়েছো তাহলে তা সময়ে

সময়েই জানতে পারবে।কিন্তু তুমি তো ধার্মিকা,নামাজীও বটে।

তাহলে কেন আমার পছন্দগুলোকে নিজের করে নিবে?

যেখানে সব পছন্দই আমার বাজে

স্ত্রী :আপনি আমার স্বামী।আপনার ভালো-মন্দ সব তো

আমাকেই দেখতে হবে।আপনাকে সুখী রাখতেই যে

আমাকে আপনার হতে হয়েছে ।

(স্বামী এবার ও চুপ।)

আপনার যদি আর কিছু বলার থাকে তো বলুন,,,

স্বামী :আমার আর কিছুই বলার নেই।এবার তোমার ব্যপারে

বলো।

স্ত্রী :আমার কোনো পছন্দ/অপছন্দ নেই।আপনিই আমার

সব।তবে আমার শুধু একটাই পছন্দ আছে।

স্বামী অধীর আগ্রহ নিয়ে বলছে,,,হ্যা বলো।তোমার

পছন্দগুলোকে আমার করে নেওয়ার চেষ্টা করবো

স্ত্রী :আমি নামাজ পড়তে ভালোবাসি।

স্বামী :তোমাকে বাধা দেবোনা।তোমার পছন্দ তুমি যেভাবে

খুশি সেভাবেই নিতে পারো,পালন করতে পারো।আর কি কি

পছন্দ করো বলো।

স্ত্রী :আমার আর কোনো পছন্দ নেই।

স্বামী : জাস্ট একটাই???

স্ত্রী :জ্বী।

স্বামী :তুমি আমার সব কিছুকে নিজের করে নিয়েছো ।আমার

ও উচিত তোমার পছন্দগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া।তবে

যেহেতু ধর্ম বিষয়ে আমার আগ্রহ নেই তাই জাস্ট

মোমেন্টে কিছু বলতে পারছিনা।আমাকে সময় দাও।

স্ত্রী :এ নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমাকে যে আল্লাহর

ইবাদাত করার সুযোগ দিয়েছেন এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।

দুজন দুজনার প্রতি সন্তুষ্ট।তারা নতুন জীবন শুরু করল।কারো

ব্যপারে কেউ কিচ্ছু বলেনা। কারো ইচ্ছাতে কোনো বাধা ও

পড়েনা।

স্বামী তার নিত্যদিনের কর্ম করেই যাচ্ছে আর স্ত্রী ধার্মিকা

হয়েও মেনে নিচ্ছে।

প্রতিদিন মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে স্বামী।

যার ফলে মাতাল অবস্থায় তার ব্যবহার পাল্টে যায়।

একদিন সকালে স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে,,,

স্ত্রী :আচ্ছা আপনি প্রতিদিন বাইরে থেকে নেশা না করে

ঘরে বসেই তো এ গুলো খেতে পারেন।

স্বামী :কি বলছো এইগুলা?এতে তো তোমার অসুবিধা হবে।

স্ত্রী :আপনার কোনো কাজে আমার কোনোরকম

অসুবিধে হবেনা।

স্বামী :তুমি তো ঘরে বসে নামাজ পড়ো।

স্ত্রী একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল ঘরটা তো আর আমার একার না ।

একপাশে আমি নামাজ পড়বো আর একপাশে আপনি যা খুশি করেন।

যদি আপনার কোনো সমস্যা না হয় ।

স্বামী :যদি তোমার কোনো সমস্যা না হয় তো আমার ও

হবেনা।

একই রুমের একপাশে স্বামী ড্রিংক করে আর একপাশে স্ত্রী

নামাজের সময় নামাজ পড়ে।

স্ত্রী নিজ হাতে ড্রিংক টেবিল সাজিয়ে দেয়।

স্ত্রীর কার্যকলাপে স্বামী বেশ অবাক।

একদিন স্বামী রাতের বেলা ড্রিংক করছে আর পাশে স্ত্রী

ইশার নামাজ শেষ করে কুরআন তেলাওয়াত করছে।

তেলাওয়াতের গভীরে পৌঁছে গেছিলেন স্ত্রী ।হঠাৎ তার

মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে তার স্বামী তো ঘরে আছেন।উনার

হয় তো তেলাওয়াতের আওয়াজে সমস্যা হচ্ছে।

তেলাওয়াত বন্ধ করে দেখে স্বামী ড্রিংক না করে স্ত্রীর

পাশে বসে এক মনে তেলাওয়াত শুনছে আর চোখ থেকে

পানি ঝরাচ্ছে।হঠাৎ করে তেলাওয়াত বন্ধ হয়ে যাওয়াতে স্বামী

স্ত্রীকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারন জিজ্ঞেস করল।স্ত্রী অতি

নমনীয় কণ্ঠে বলল,আপনার এতে সমস্যা হচ্ছে হয় তো।

স্বামী : আমি তো বলিনি যে তোমার তেলাওয়াত আমাকে

সমস্যা করছে।তবে এটা সত্য যে তোমার তেলাওয়াত আমার

ভেতরে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।

স্ত্রী :যন্ত্রণায় তো আপনার রেগে যাওয়ার কথা।তা না করে

আপনি কাঁদছেন কেন?

স্বামী তখন আরো চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে

বললেন,,,তুমি কেন আমায় ধর্ম বিষয়ে কিছু শিক্ষা দিলে না?

স্ত্রী ও চোখের পানি ফেলে বলল,,আপনিই তো

বলেছিলেন ধর্ম বিষয়ে আপনার পছন্দ না।

স্বামী ও বলল,,আমি তো এ ও বলেছিলাম যে তোমার

পছন্দগুলোকে আমার করে নেওয়ার চেষ্টা করবো,এখন তাই

করছি।প্রথম রাতেই আমার উচিত ছিল তোমার পছন্দগুলোকে

আমার নিজের করে নেওয়ার ।বড্ড দেড়ি হয়ে গেছে আমার

রবকে চিনতে।এই বলে স্বামী যেন আরো উচ্চ কান্না

কাঁদতে লাগলো।

স্বামী চোখ মুছে আবার বলতে লাগল,,আচ্ছা তুমি তো

কোনোদিন আমায় ধর্ম নিয়ে কিছু বলোনি।এমনকি গতকাল ও

আমি ধর্মের প্রতি উদাসীন ছিলাম।তুমি কি এমন করেছো যে

আজ আমি ধর্মের প্রতি এতো দুর্বল হয়ে পড়েছি।

স্ত্রী তখন বলল,,,হয় তো আপনাকে সরাসরি ধর্ম নিয়ে কিছু

বলিনি।তবে প্রতিদিন আমি আপনার হেদায়েতের জন্য মহান রব্বুল

আলামিনের দরবারে কেঁদেছি।প্রতিটা রাত আমি তাহাজ্জুত নামাজ

পড়ে পার করেছি।প্রতিটা নামাজের মোনাজাতে আপনাকে

রেখেছি।

আর আমি প্রথম রাতেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনাকে

ধর্মের দিকে দাওয়াত দিলে আপনি ফিরবেন না।কেননা আপনার

পছন্দের বাইরেই ছিল ধর্ম।কেউ সহজেই নিজের পছন্দ

ছেড়ে দিতে পারেনা।তাই আমি ধৈর্য ধরেছি আপনার

হেদায়েতের জন্য।তাওয়াক্কুল করেছি আল্লাহর প্রতি যে

একমাত্র আল্লাহ্ই পারে আপনার মনকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট

করতে।আর কৌশলে আপনাকে ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার

আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।অবশেষে আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল

করেছেন।

স্বামী ও তখন বুঝতে পারলো যে ড্রিংক করার জন্য ঘরে

কেন আহ্বান করল।

এতোদিন ভুল পথে থাকার জন্য স্বামীকে দিয়ে তওবার নামাজ

আদায় করায় স্ত্রী ।নিজেও শুকরিয়া সিজদাহ দেয় দোয়া

কবুলকারী মহামহিম আল্লাহর চরণে।

এখন আর একপাশে নামাজ আদায় আর একপাশে ড্রিংক করা হয় না।

স্বামী-স্ত্রী একসাথে নামাজ আদায় করে।গভীর রাত পর্যন্ত

জেগে স্ত্রীর কুরআন তেলাওয়াত শুনে স্বামী।নিজেকে

পরিপূর্ণ ইসলামের রঙে রঙিন করে তুলে স্ত্রীর সহায়তায়।😍

পূর্বেকার নাফরমানির কথা স্মরণ করেই সিজদায় ডুকরে ডুকরে

কাঁদে স্বামী।একেকটা পাপের কথা স্মরণ করে আর

ইস্তেগফার করে।😍😍😘😘




Post a Comment

0 Comments